হারানো দিনের বন্ধুত্ব - সানজিদা হোসাইন

নবীন দীপ্ত

আজকের আকাশটা মেঘে ঢাকা, সুন্দর। এর আগেও তো বহুবার দেখেছি, আজ কিছুটা অন্য রকম লাগছে। এই মুহূর্তে আমি এক রাস্তার পাশে বসে আছি। এর আগেও অনেকবার এখানে বসেছি, বন্ধুদের সাথে একসাথে এই পথে চলছি। এই রাস্তার সাথে আমার ১০ বছরের বেশি সম্পর্ক, তাই এই রাস্তাকে আমার বন্ধুও বলা যায়। রোজ যে স্কুলে যেতাম এই পথ ধরে! তবে আজ অনেকটা শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। নিজেকে অনেক একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যদি আজ আমার পাশে আরও কয়েকজন থাকত তবে বেশ ভালো লাগত। বন্ধুদের কথা বলছি। বন্ধুত্ব এক পবিত্র সম্পর্ক, যাকে মনের সব কথা বলা যায়,বিশ্বাস করা যায়। যার সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তবুও আপন করে নেওয়া যায়৷ যে কথা অন্য কাউকে বলা যায়না তা,বন্ধুকে বলা যায়।

 একসময় ছিল যখন রোজ দিনে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ওদের সাথে কাটাতাম, হৈ চৈ করতাম, গল্প করতাম আর এখন ৮ থেকে ১০ দিনে হয়ত একবার ওদের সাথে ফোনে কথা হয়, খুব বেশি হলে দু চার মিনিটের জন্য। আজ শেষ থেকেই শুরু। হঠাৎ-ই একদিন স্কুলে গেলাম, আর আমার জীবনের সবকিছু বদলাতে শুরু করল। স্কুলে যেতে ভয় পেতাম,আম্মু আমায় অনেক বোঝানোর পরও বলতাম, আজ সারাদিন বাসায় পড়ব তবুও স্কুলে পাঠিয়ো না। চিনতাম না, জানতাম না তাদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের সাথে এই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম,আসতাম, ঘুরে বেড়াতাম। যেদিন প্রথম স্কুলে যাই,খুব ভয় হচ্ছিল। ভীতুর ডিম ছিলাম আমি।

শিক্ষকদের তো ভয় পেতামই,সাথে নতুন সব সহপাঠীদেরও  ভয় পেতাম। তার মধ্যে ছিল এক রাগী ম্যাডাম। এত ভয়ের মধ্যে শুরু হওয়া সব কিছু ঠিক হতে লাগল। যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তাম তখন একবার খুব কান্না করেছিলাম।কারণ, আমি তৃতীয় শ্রেণীতে উঠতে চাই না। আমি ভাবতাম হয়ত আমার বন্ধুরা ওখানেই থেকে যাবে,তবে তো আমায় সব নতুন করে শুরু করতে হবে। তখন মা আমায় বোঝালেন যে,আমি একা নই, ওরাও আমার সাথে যাবে। অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিলাম সেদিন। শুরুতে আমার কোনো বন্ধুই ছিল না।

আমি সহজে সবার সাথে মিশতে পারি না। তাই মা আমার বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছিল। এখনও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, সেদিন মা যদি ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব না করিয়ে দিত, তবে এই গল্পের অন্য মোড় হতো কিনা তা ঠিক জানিনা। শত পড়াশোনার ঝামেলার মধ্যেও আমাদের বন্ধুত্ব চলছিল। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতে সবাই পরীক্ষা দিলাম,সেই সময়ে ফলাফল ভালো ছিল,৫.০০। সবাই পাশ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলাম,বড় হওয়ার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব ও গভীর হচ্ছিল। ঝগড়াঝাটি,মারামারি কখোনোই পছন্দ ছিল না। বলা যায় আমায় দিয়ে বাকি সব কিছু হলেও, ঝাগড়াটা কখোনোই হবে না। রেগে গেলে আমি চুপ করে থাকি,কেন জানি কথা বেরোতে চায়না৷ তাই আমার কখোনোই কারো সাথে বড় ঝামেলা হয় নি। তাই পুরো ক্লাসের সবাই আমার বন্ধু ছিল। ছোটখাটো মনমালিন্য হতো ঠিক, তা পরক্ষণেই আবার ঠিক হয়ে যেতো।আমি কিছুটা রগচটা, হঠাৎই রেগে যাই,এটাই তার মূল কারণ ছিল।ওরা মানিয়ে নিত,আমিও নিতাম।

তারপর অষ্টম শ্রেণি শেষ করে নবমে যেতেই এক ঝামেলা হলো আমার। বিভাগ নির্বাচনী, পরীক্ষায় কিছু মার্কের জন্য পাশ না করায়, আমাকে সাইন্স থেকে বাদ চাওয়া হলো। যার কারণে বাড়িতে অনেক বকাবকি করল, ঐ দিনগুলো আমার খুব খারাপ গেলো৷ আমি একা না,আরোও কয়েকজন ছিল, পরে সবাই মিলে প্রধান শিক্ষককে বলে সাইন্স বিভাগে উঠি। পড়াশোনা শুরু করি। রোজ সবাই মিলে কোনো না কোনো দুষ্টুমি করতাম। ঘুরতে যেতাম, কখনো অন্য বন্ধুর বাড়িতে, কখনো এমনিতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায়।

হঠাৎ কোনো বন্ধুকে ধরে তাকে দোকানে নিয়ে তার পকেট ফাকা করতাম। কখনো তো স্যারদেরও ছাড় দিতাম না। সব  স্যারই আমাদের স্নেহ করতেন৷ একজন রাগী স্যারও ছিলেম। তাকে তো সবাই ভয় পেত।  রুহুল কুদ্দুস আমাদের জীববিজ্ঞান স্যার। 

তারপর এলো আমের মৌসুম,সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে এই দিনগুলোতে। ক্লাসরুমের একটু দুরেই ছিল এক আম গাছ, টিফিনের সময় স্কুলের পেছনে লুকিয়ে গিয়ে আম পেঁড়ে আনতাম। কেউ লবন নিয়ে আসত, পেছনে আরেকটা তেতুলের গাছও ছিল। কখনো ক্লাসের ভেতর থেকেই আম পেড়ে নিতাম। বাসা থেকেও নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খেতাম। আজ এখানে সেই মুহূর্তগুলোর কথা ভীষণ মনে পড়ছে। কতটা রঙিন ছিল সেই দিনগুলো। অনেকদিন হয়ে গেছে ওদের সামনে থেকে দেখি না, ওদের হাত ধরি না। কেউ কাউকে নিয়ে মজা করি না,কেউ কোনো কথাতে কাউকে মারতেও পারিনা।

এই বন্ধুত্ব যেন আকাশে কর্পুরের মতো উবে গেছে। এই গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্কটা যেন আমার কল্পনায় আছে যাকে বাস্তবে ছুতে পারছি না। তারপরেও কোথাও একটা দুরত্ব ছিল বলে মনে হতো, আজ এখানে বসে তা মনে হচ্ছে না,না! কোনো ফাঁক-ই ছিল না। যদি আবার একজন আরেকজনের হাত ধরতে পারতাম,তবে নিমিষেই সব দুরত্বকে গায়েব করে দিতাম। এই বন্ধুত্বকে আজ এই কাগজে লিখে শেষ করলেও, কখনো মন থেকে মুছে যেতে দিতাম না, সামনেও দেব না ।একসাথে তোলা সেই পুরোনো ছবিগুলো সযত্নে আগলে রেখেছি, যেন পরে তা দেখে ফিরতে পারি ফেলে আসা সেই সোনালি সময়ে, অনেক অনেকদিন পরে হলেও।

তখন হয়ত আর কথাটুকুও হবে না, কিন্তু ওদের কথা মনে হবে। হয়ত শত কাজের মাঝে কিংবা মাঝরাতে কোনো এক সময় ওদের কথা মনে হবে তখন। আর সেই ছবিগুলো দেখে তার পেছনের স্মৃতি, কাহিনী মনে করে হাসব না হয় ব্যাকুল হব। এই স্মৃতিগুলো মরে যাবে না, নিঃশেষও হবে না কোনোদিন। বন্ধুরা থেকে যাবে আমার বন্ধুত্বের মতোই  চিরদিন, হৃদয়ের গভীরে৷  বেঁচে থাক সব বন্ধুত্ব, সারাবেলা, সারাজীবন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মায়াবী নদী - স্বপ্না ফাতেমা

শৈশবের স্কুল জীবন - আবু তাহের ইসলাম

স্মৃতির পাতা - সানজিদা হোসাইন