শৈশবের স্কুল জীবন - আবু তাহের ইসলাম

নবীন দীপ্ত

শৈশব কাল কতই না সুন্দর ছিল। ছিল না কোনো চিন্তা-ভাবনা, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধূলা আর ঘুমানো। এ সময় সন্তানকে পিতা মাতা যা শিখায় সন্তান তাই শিখে। জীবনের প্রথম স্পর্শ মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। ছোটবেলায় সন্তান যখন কান্না করে, মা ছাড়া কেউ তার কান্না থামাতে পারে না। কারণ পিতা-মাতা সন্তানকে যেভাবে আদর যত্ন দিয়ে ভালোবাসে তেমন করে পৃথিবীর কেউ আর আদর যত্ন দিয়ে ভালোবাসতে পারে না। পিতা-মাতার কাছে সন্তানের শিক্ষা বেশি প্রয়োজনীয়। পিতা-মাতা হাতে-কলমে সব শিক্ষা দিতে না পারলেও পিতা-মাতার শিক্ষা সন্তানের জন্য আদর্শ  শিক্ষা। পিতা-মাতার কাছে সন্তান ভালো-মন্দ সব শিক্ষা পায়। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল, কি করলে ভালো হবে আর কি করলে মন্দ হবে, সেসব শিক্ষাও পায়। শৈশবকাল সবার কাছে একরকম হয় না, কেউ পায় অবহেলা আবার কেউ পায় ভালোবাসা।

আমি মা বাবার ভালোবাসা ও শাসন দুটোই পেয়েছি।  বাবারা সন্তানের ভালোর জন্য সন্তানকে শাসন করে। সারাদিন যখন বালুতে খেলা করতাম, মা প্রথমে বকা দিত তারপর গোসল করিয়ে দিত। অনেক সময় মায়ের কোলে প্রসাব করে দিতাম। তবুও মা একটুও রাগ না করে আদর করতো।  একদিকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে থেকে মাকে কতই না কষ্ট দিয়েছি অন্যদিকে পৃথিবীতে এসেও  কষ্ট ও  দিয়েছি সাথে অনেক জ্বালিয়েছিও। তবুও মা সকল কষ্ট আর জ্বালা সহ্য করে আমাকে আদর ও ভালোবাসা দিয়ে ভালো-মন্দ শিখিয়েছেন। অন্যদিকে বাবার অবদানও কম নয়।  আদর অল্প থাকলেও শাসন একটু বেশি ছিল। আমি যেন কোন ভুল না করি সে জন্য তিনি শাসন করতেন। ছোট থেকেই দেখেছি বাবা সংসারের জন্য  অনেক কষ্ট করে আয় করেন। যে মানুষটা নিজে খেয়ে না খেয়ে সংসারের জন্য এত কষ্ট করেন মায়ের থেকে শুনেছি…..

আমার বয়স যখন দুই মাস তখন আমার বাবা, পরিবারের মায়া ছেড়ে কাজের জন্য মালয়েশিয়ায় যান। তখন আমি,  আমার বড় ভাই আর মা একসাথে ছিলাম। মা যখন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তখন ভাইয়া আমাকে দেখে রাখতো। 

আবার ভাইয়া যখন স্কুলে যেত তখন  আমার এক দাদি আমাকে দেখাশোনা করতেন।  কিন্তু সে দাদিকে আমার দেখার কখনো সৌভাগ্য হয় নি।

কারণ তখন তো আমি কিছুই জানতাম না কিছুই বুঝতাম না। বুদ্ধি হওয়ার আগেই দাদী ইন্তেকাল করেন।  দোয়া করি আল্লাহ দাদিকে যেন জান্নাতবাসি করেন। মা বলে আমি নাকি পরিবারের অনেক আদরের সন্তান ছিলাম। একবার আমার কি যেন হয়েছিল। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। মা আমাকে দোলনায় রেখে  নদীতে কাপড় খাঁচতে গিয়েছিলেন। আমার ছোট আব্বু আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে কোলে করে হাসপাতালে গিয়েছিলেন।  এভাবে আমাকে সবাই আদর যত্ন দিয়ে বড় করে তোলে!

ধীরে ধীরে যখন একটু একটু করে ভালো-মন্দ বুঝতে শিখি তখন খেলাধুলার পাশাপাশি কাগজে-কলমে শিক্ষার জন্য বেঁছে নিতে হয় স্কুল।  স্কুলে প্রথম যখন ভর্তি হই তখন আমার ভর্তির রোল ছিল ৬৬। পড়াশোনা কি তা বুঝতাম না। শুধু স্কুলের বই নিয়ে আসা-যাওয়া করতাম। স্কুলে যাওয়ার জন্য দুইটা পথ ছিল। একটা নদীর পার হয়ে আর অপরটা রাস্তা দিয়ে। নদীপথ আমার খুব প্রিয় ছিল। তাই নদীপথ দিয়েই বেশির ভাগ যাওয়া আসা করতাম।

নতুন বই কখনো কোলে, কখনো মাথার উপরে রেখে স্কুলে যাওয়ার পথে হেঁটে হেঁটে যে দুষ্টমি করেছি আর রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ধুলা-বালি উড়িয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, তা হয়তো প্লেনে উড়ে যাওয়ার চাইতেও বেশি মজার মুহূর্ত। অনেক সময় বাড়িতে আগে আসার জন্য ও প্রতিযোগিতা চলতো। আমি নিয়মিত স্কুলে যেতাম আর স্কুলে পৌঁছে সামনে বসার জন্য প্রতিযোগিতা করতাম। সামনের বেঞ্চে যদি কেউ বই রাখতো তাহলে তার সাথে ঝগড়া করে হলেও সামনে জায়গায় বসতাম। সামনে সিটের জায়গায় বসা যেন আমার অধিকার ছিল।

দিনকাল ভালই কাঁটছিল। হঠাৎ ভর্তি হওয়ার পাঁচ থেকে ছয় মাস পরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে বাসায় থাকতাম। এর কারণ যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম সেই স্কুলটি একটু দূরে। তাই বাসার কাছে একটি স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমার সহপাঠীরা যখন স্কুলে যায় সেই সময়টি খুব মনে পড়ছিল। সহপাঠীদের সাথে ক্লাশে বসে গল্প আর খেলাধুলার করার মুহূর্তের কিছু স্মৃতিও আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাসায় থেকে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের সাথে কাবাডি, হা-ডু-ডু, বউচি, লুকোচুরি ইত্যাদি খেলেছি। স্কুলেও ওইসব খেলতাম এর জন্য স্কুলের চারপাশের সবাই আমাকে ভালো করেই  চিনে! স্কুলের চারিপাশ আমাকে আপন করে নিয়েছিল।

আমি প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালোবাসি।  আমাদের স্কুলের চারপাশে জঙ্গল ও বাঁশঝাড়ে সাথে কবরস্থানে ভরা। অনেকে আমাদের স্কুলটি খুব ভয় পেত। যখন একটু বাতাস বয়ে যেত তখন বাঁশঝাড় থেকে থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসতো।  তখন কেউই ক্লাসরুম থেকে বের হতে চাইতো না। কিন্তু আমি খুব সাহসী ছিলাম। আমি ওই অদ্ভুত আওয়াজ দেখার জন্য বাঁশঝাড়ের কাছে যেতাম। গিয়ে যা দেখতাম  তা সত্যি অবাক করা।

কোথায় কি? বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণ লেগে আওয়াজ হচ্ছে। এমন আওয়াজে আসলেই ভয় পাওয়ার কথা না। আমাদের স্কুলের মাঠের মাঝখানে বড় একটি বট গাছ ছিল। অনেকে বলে গাছে নাকি অদৃশ্য কিছু আছে। স্কুলের স্মৃতি কি কখনো ভুলা থাকা যায়। স্যার-মেমরা যে আদর করে পড়াতো, সে সব বার বার মনে পড়তো। পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষক শুধু শিক্ষায় দেন না, সাথে আরো অনেক কিছু শিখিয়েও দেন!

ছয় মাস পর যখন নতুন স্কুলে ভর্তি হতে চাই তখন আগের স্কুলের হেড স্যারের বাধার কারণে ভর্তি হতে পারি নি। তাই আবার ফিরে যেতে হয় আগের স্কুলে। তত দিনে  আমার সহপাঠীরা সবাই উপর ক্লাসে উঠে যায়। আমি পাই নতুন সহপাঠী। ক্লাস ওয়ানের দ্বিতীয়বার ভর্তি রোল ছিল ৫২। নতুন সহপাঠীদের কেউ কেউ ছিল পড়াশোনায় মনোযোগী। আবার একদল সহপাঠী ছিল যারা পড়াশোনায় অমনোযোগী। আবার কিছু সহপাঠী ছিল হিংসুটে। যারা পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল তাদের সাথে কথা বলতাম, খেলা করতাম।  কিন্তু হিংসুটে সহপাঠীরা আমাদের খেলার মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করতো। কারণ, তারা ছিল স্থানীয়। হিংসুটে সহপাঠীরা সবকিছুতে আমাদের বিপক্ষে থাকতো।

এ জন্য অনেক ঝগড়া হতো আমাদের মধ্যে। আমরা দুটো দলে বিভক্ত ছিলাম। আমাদের দলে মেয়েরাও ছিল। হিংসুটে সহপাঠীদের সাথে মেয়েরা কথা বলতো না। আমাদের দলে আমরা ছেলে-মেয়েরা সবাই মিলেমিশে থাকতাম। একে অপরকে সাহায্য করতাম। কেউ পড়ার না বুঝলে বুঝিয়ে দিতাম। ক্লাসে পড়া না পারলে বলে দিতাম। বেশিরভাগ সময় ক্লাসে বসে গল্প করতাম। প্রথম প্রথম মেয়েদের সাথে তেমন কোনো  পরিচয় ছিল না  কারণ মেয়েদের সাথে যে কথা বলতে গেলে এক প্রকার লজ্জা কাজ করতো। ধীরে ধীরে তাদের সাথে পরিচয় হয় ক্লাস টুতে এসে।

ক্লাস ওয়ানে পড়াশোনা তেমন না করায় ক্লাস টু তে এসে রোল হয় ৩৩। ক্লাস ওয়ানে পড়াশোনা কি সেটাই জানতামই না। আর পরীক্ষা ভালো করব কেমনে, স্যার ম্যামরা ক্লাসে যা পড়াইছে সেটাই একটু একটু মাথায় রেখেছিলাম এবং পরে পরীক্ষায় ওসব লিখি। ক্লাস টু তে এসে পড়াশোনার প্রতি একটু আগ্রহ বাড়ে। যখন দেখলাম  কিছু ছাত্র-ছাত্রীর রোল ১,,,। আর আমার রোল অনেক কম।  এটা কেন হবে আমিও  লিখি তারাও লেখে। জ্ঞান আমারও আছে তাদেরও আছে। আমি বুঝলাম, আমার জ্ঞানটা পড়াশোনায় ছিল না। ছিল খেলাধুলা আড্ডায় ও গল্পতে।

তখন থেকে নিজেকে নতুন রূপে তৈরি করলাম। মা যখন সন্ধ্যায় রান্না করতে বসতো তখন আমি বই নিয়ে গিয়ে  হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তাম। কিছু না বুঝলে মায়ের থেকে জেনে নিতাম। আর মা রাগ না করে বারবার বুঝিয়ে দিতেন। এভাবে ক্লাসের সব পড়া বাসায় করে যেতাম। কোনো পড়া বাকি রেখে কোনোদিন স্কুলে যাই নি। নিয়মিত ক্লাসে পড়া দিতে পারি বলে স্যার ম্যামরা অনেক আদর করতো।

সহপাঠীদের সাথে  কথা হতো ঠিকই, কিন্তু পড়াশোনার কারণে সব সময় খেলাধুলা করতাম না। মাঝে মাঝে বেশিরভাগ সময় নদীর পাড়ে গিয়ে বই নিয়ে বসতাম। খেলার জন্য সহপাঠীরা খুঁজতে খুঁজতে নদীর পাড়ে যেত, কিন্তু খেলাধুলার  চেয়ে তখন আমার মন ছিল বেশি পড়াশোনায়।

টিফিনের সময় আগে যেখানে খেলতাম সেই সময়টায় আমি নদীর পাড়ে গিয়ে বসতাম। আর  নদীতে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাবতাম, আমি যদি পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করি, তাহলে আমার পরিবার অনেক খুশি হবে।  এভাবে একটা বছর মন দিয়ে পড়াশোনা করি। পড়াশোনা তখন অনেক ভালো লাগতো।  পড়াশোনা করতে করতে কখন যে একটা বছর পেরিয়ে গেল টের পাইনি ।

হঠাৎ করে শুনি ক্লাস টু-তে বাষিক পরীক্ষা শুরু হবে।  পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার সব প্রস্তুতি নিয়ে  সবার থেকে দোয়া নিয়ে পরীক্ষা দিতে যাই। একটা বছর যেভাবে পড়েছি, ততদিনে বুঝেছি পরীক্ষা  কি? আর কিভাবে দিতে হয়।  নিজের জ্ঞানে মাথায় যা ছিল সেটাই পরীক্ষায় লিখি। সব বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর রেজাল্টের জন্য কয়েকদিন ঘুমাতে পারি নি।  বারবার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ কি যেন হয়েছে। পাস করতে পেরেছি নাকি ?

রেজাল্টের দিন মা আমাকে সাজিয়ে দেয়। স্কুলে গিয়ে রেজাল্ট পেয়ে সত্যি সেদিন আমি কান্না করেছিলাম। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম পাশ করতে পেরেছি কিনা। কিন্তু না, আমি রেজাল্ট পাওয়ার পর সত্যি অবাক। আমি তৃতীয় শ্রেনিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা পাওয়া। আমার বাবা-মা ও সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল। সেদিন আমি কান্না করেছি ।কারণ সেদিন আমার খুশিতে চোখে জল এসেছিল! এতটা খুশি হয়তো শৈশবকালে কখনো হই নি।

এসব কিছু হয়েছে আমার আব্বুর জন্য, আব্বু আমাকে নিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় পড়াতে বসতো। তখন আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কারন আব্বু রেগে গেলে বেত পাশে রেখে পড়াতো। যখন পড়া পারতাম না বা ভুল হতো তখন বেত দেখিয়ে পড়া সঠিক করে বুঝিয়ে দিতেন। আর তখন অবশ্য পারতাম। যদিও আব্বু মারতো না কিন্তু অনেক সময় এমন হয়েছে যে পড়তে পড়তে চোখের পানিতে খাতা বইয়ের পৃষ্ঠা ভিজে যেত।

আর তখন আব্বুর উপর খুব অভিমান হতো। কিন্তু পড়া শেষ হলে আমার আব্বু আমায় খুব আদর করত। আর তখন অভিমানগুলো হারিয়ে যেত। কারণ আমি মনে করতাম, আমার ভালোর জন্য আমাকে শাসন করে। আর সে জন্য আমার পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। আমার স্কুলের প্রিয় স্যার ম্যামরা আমায় খুব আদর করতো। কারণ, আমি ক্লাসের পড়া ক্লাসেই দিতাম কখনো পড়া না পড়ে স্কুলে যেতাম না। ক্লাসে আমাকে যে সহপাঠী সবচেয়ে সাহায্য করত, সে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। আস্তে আস্তে তৃতীয় শ্রেণিতে যখন উঠলাম তখন আমার প্রিয় একজন বন্ধু হয়ে ওঠে । আমাদের বন্ধুত্বটা ছিল স্কুল জীবনে সবচেয়ে সেরা।

ছোটবেলায় বুঝতাম না বন্ধুত্ব মানে কি? যখন বুঝলাম যে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে, বন্ধুরা পাশে থাকলে সবকিছুই ভালো লাগে। বন্ধুরা পাশে থাকলে কোন বিপদে বাঁধা মনে হয়না। বন্ধুরা মিলেমিশে থাকলে তাদেরকে কেউ আলাদা করতে পারেনা। এজন্য বন্ধুত্ব আমার এত প্রিয়।সবাই বন্ধু হতে পারেনা। বন্ধু হওয়ার জন্য দরকার আলাদা অনুভূতি। ভিন্ন রকমের সম্পর্ক বন্ধুত্ব।  বন্ধুত্ব কখনো ভুলে থাকা যায় না। বন্ধুরা  হচ্ছে একে অপরের অক্সিজেন যাদের ছাড়া বেঁচে থাকতে কষ্ট হয়। হতে পারে মান-অভিমান কিন্তু আজকে আড়ি কালকে আবার মিল এটাই তো বন্ধুত্ব। আমি আমার বন্ধুদের অনেক ভালবাসি। আর ভালোবাসি বলেই আমার প্রতিটি মোনাজাতে তাদের জন্য দোয়া করি। বন্ধুদের ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। আমি সবসময় ছুটেছি বন্ধুত্বের পিছনে। আমার কাছে মনে হয় যে কোনো কারণ ছাড়াই পাশে থাকে সেইতো বন্ধু। রূপ বা সৌন্দর্য দিয়ে বন্ধুত্ব হয়না বন্ধুত্ব হতে গেলে সুন্দর একটা মনের প্রয়োজন হয়। 

বন্ধুত্ব যে রূপে থাকে না যার মন ভালো সে তো বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা রাখে। যার সাথে মন খুলে মনের কথা শেয়ার করা যায় সেই তো বন্ধু। বন্ধুত্ব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ মনে হয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বন্ধুর সাথে কাটায়। বন্ধুর সাথে ঝগড়া মান-অভিমান যাই হোক না কেন তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত ভালো থাকা যায় না। জীবনে সবসময় বন্ধুকে পাশে প্রয়োজন হয়। বন্ধুই পারে নিজের জীবন থেকে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে বন্ধুকে ভালো ও খুশি রাখতে । সত্যিকারের বন্ধুত্বে যে কোনো চাহিদা থাকে না। শুধু থাকে সারা জীবন একসাথে থাকার পরিকল্পনা। বন্ধুত্ব হচ্ছে পবিত্র কারণ আল্লাহ তাআলা নিজে আল কুরআনে বন্ধুত্বের কথা বলেছেন। হাজার অপমান করার পরেও কেউ কাউকে ছেড়ে যায়না। যে ছেড়ে যায় সে কখনো বন্ধু পারে না। কারণ সত্যিকারের বন্ধুত্বে অভিযোগ থাকলেও অভিনয় থাকে না। বন্ধুত্বের ভালোবাসা প্রকাশের বিষয় নয়, বন্ধুত্বের ভালোবাসা হচ্ছে অনুভবের বিষয় যা অনুভূতি সৃষ্টি করে!

আমার এখনো মনে আছে দ্বিতীয় শ্রেণীতে যখন ক্লাসে পড়া দিতাম। যদি পড়া না পারতাম আমার প্রিয় বন্ধুটি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া বলে দিত। আমরা বেশিরভাগ সময় ক্লাসে পড়া নিয়ে আলোচনা করতাম। স্যার কোন পড়া দিলে কোন পড়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার এমনও হয়েছে কোনোদিন যদি আমার মন ভালো না থাকতো ক্লাসে না গিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। বন্ধুটি যখন আমায় ক্লাসে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে নদীরপাড়ে গিয়ে দেখতো আমি মন খারাপ করে বসে আছি সে যেভাবেই হোক না কেন আমার মনটা ভালো করে দিত। 

আর তার অনেক কথা আমার সাথে শেয়ার করতো।তার মনের যত কথা যা আমাকেই শুধু বলেতো। সবসময় আমার বন্ধুটি আমার পাশে ছিল। খেলাধুলায় হোক বা পড়াশোনায় হোক সব জায়গাতেই তার সাহায্য পেয়েছি। পড়াশোনায় সে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে আমার উপরে অবস্থানে ছিল। চতুর্থ শ্রেণীতে এসেও আবার আমার রোল হয় ৩। আমরা সব সময় একসাথে থাকতাম স্যার ম্যাম কিছু করতে বললে আমরা একসাথে করতাম। পানি খাওয়ার নাম করে ক্লাস থেকে দুজন একসাথে বের হয়ে পুরো স্কুল ঘুড়ে বেড়াতাম, আর গল্প করতাম।আমরা স্কুলে খুব আড্ডাবাজ ছিলাম, মাঝে মাঝে টিফিন টাইমে স্কুল পালাতাম!

এভাবে কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। খুব তারাতাড়ি চতুর্থ শ্রেনির পরিক্ষা এসে যায়। আর চতুর্থ শ্রেণীর বাষিক পরীক্ষার ফলাফল যে এমন হবে এটা আমি আশা করিনি।যদিও আমি ২য় স্থান পেয়েছি এর চেয়ে খুশির দিন আর কি হতে পারে!! পরিক্ষার ফলাফল পেয়ে আমি সেদিন অবশ্য অনেক খুশি ছিলাম কিন্তু আমার বন্ধুটার ফলাফল দেখে কেমন জানি লেগেছিল । একসাথেই পাশাপাশি পরিক্ষা দিয়েছি সাহায্য নিয়েছি। আর সাহায্যও করেছি, কিন্তু তার ফলাফল ভালো হয়নি। আর এমনটা কখনো চাইনি যে আমি তার আগে যাই, আমি সব সময় চেয়েছি সে ভালো রেজাল্ট করুক।

বন্ধুত্বের ভালোবাসা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়। জীবনে আরো সত্যিকারের ভালোবাসা দেখছি মা-বাবা সন্তান ও ভাই বোনের মাঝে। মা বাবাকে সন্তান যেমন ভালোবাসে তার চেয়েও শতগুণে  মা বাবা সন্তানকে বেশি ভালোবাসে। আবার ভাই বোনের সম্পর্ক এমন সব কিছু নিয়ে ঝগড়া করবে আবার একে অপরের দুঃখে কষ্ট পাশে থাকবে। কোনো ভাই তার বোনের চোখের পানি সহ্য করতে পারে না আবার বোনের জন্য জীবন দিতেও রাজি তবু বোনের কোনো ক্ষতি হতে দেয় না তেমনি সব বোন তার ভাইকে একই ভাবে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে।আমার নিজের কোনো বোন নেই। কিন্তু বোন না থাকার অনুভূতি ঠিকি পেয়েছি। যখন দেখেছি কেউ আদর করে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকে না, ভাইয়া এটা নিবো সেটা নিবো এমন  জেদ ধরে আবদার কেউ করে না। 

মা যখন একা একা রান্না করতো তখন মা কে সাহায্য করতাম। আর তখন ভাবতাম আমার যদি একটা বোন থাকতো আমার চেয়ে বেশি মা কে সাহায্য করতো। কিন্তু সে ভাগ্য আমার হয়নি!নিজের বোন না থাকলেও চাচাতো মামাতো ফুফুতো বোন ছিল কিন্তু নিজের বোনের মতো আপন কেউ হতে হতে পারে না! তবে ছোট থেকে আমাদের বাসায় আমার খালাতো বোন থাকতো তাকেই আপু বলে ডেকেছি! সে আমাদের বাসায় থাকতো আর মাকে সাহায্য করতো। আমাদের পরিবারের সবার জন্য সকাল সকাল ভাত রান্না করে দিতো আর আমি সকাল সকাল খেয়ে স্কুলে যেতাম।

প্রতিদিন সকালে স্কুলে গিয়ে আমি আমার বন্ধু পতাকা টাঙ্গিয়ে দিতাম এটা আমার অনেক ভালো লাগতো, বেশিরভাগ সময় স্কুলের সকল শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে পিটি করা হতো,  আমি আর আমার বন্ধু আর কয়েকজন সামনে যেতাম ।আমি কখনো কোরআন তেলাওয়াত, কখনো শপথ, আবার সবাই মিলে একসাথে জাতীয় সংগীত গাইতাম। আমি একটু ভাল পারতাম বলে প্রতিদিন স্কুলে ক্লাসে আমার থেকে স্যার ম্যাম  আর সহপাঠী জোর করে ইসলামিক ও দেশের গান শুনতো। ইসলামিক ও দেশের গানের প্রতি আমার একটু বেশি আগ্রহ ছিল!আমি আমার মায়ের কাছে ইসলামিক ও দেশের গান শুনে শুনে গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম, কখনো নদীর পারে বসে কখনো পুকুর পাড়ে বসে আবার কখনো স্কুলের বাগানে বসে। স্কুলের বাগানটিতে বন্ধু সহপাঠী মিলে গাছ লাগিয়েছি । 

বাগান করা আমার একপ্রকার শখ। প্রাকৃতিক সবুজ পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে। বাগানে অনেক রকম গাছ রয়েছে, গাছ নিয়ে। ঝগড়াও করেছি। গাছগুলো লাগানোর জন্য আমরা দুই দলে বিভক্ত ছিলাম। বিরোধী দলে ছিল আমার হিংসুটে সহপাঠীরা তাদের গাছ সঠিক পরিচর্চা না করার কারণে ছোট ছিল এবং অনেক গাছ মারা গিয়েছিল। কিন্তু আমি আর আমার প্রিয় সহপাঠীরা মিলে আমাদের গাছগুলোকে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে তুলি।

এদিকে প্রাইমারী জীবনের বিদায় এর সময় এসে যায়।প্রাইমারী স্কুল জীবনের বিদায় এর দিন হাঁসিখুশি ছিলাম কারন তখন তো বুজতাম না বিদায় মানে আসলে কি?বিদায়ের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাই ।গিয়ে দেখি বিদায়ের আয়োজন করা হয়েছে। এর আগে পাঁচটি বছর দেখেছি আমার বড় ভাইয়া আপুরা সবাই একটা সময়ে এসে বিদায় নেয়। একইভাবে আমরাও বিদায় নিয়েছি। কিন্তু আমাদের বিদায়ের দিনটি ছিল একটু ভিন্ন রকম। আমরা হলুদ বরণ মালা কিনেছিলাম একজন আরেক জনকে পড়িয়ে দিয়েছিলাম!সারাদিনটা আনন্দ করে দোয়া মাহফিল শেষে যখন বাসায় ফিরে আসি মনের ভিতর অজান্তেই একটি অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এটা কি করলাম? কেন বিদায় নিলাম। আর কি ঐ স্কুলে যেতে পারবো? আর কি স্যারদের সাথে আনন্দ করতে পারব? আরকি ক্লাস রুমে বসে ক্লাস করতে পারবো? আর কি স্যার ম্যাম ও সহপাঠীরা আমার গান শুনতে চাইবে? এসব প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই থেকে যায় উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না!

দিন যত যেতে লাগলো একদিকে প্রিয় সহপাঠী ও স্যার ম্যামদের মনে পড়তো। অন্যদিকে বাসায় বসে পি.এস.সি. পরীক্ষার এর প্রস্তুতি নেয়।  পি.এস.সি. পরীক্ষার রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি অবাক করা কান্ড হলো আমি আর আমার বন্ধু এক জায়গায় বসে পরীক্ষা দিয়েছি। আর দুজনেই ৪.৮৩ করে স্কুলের ভিতর আমরা দুইজন প্রথম হয়েছি। যদিও এখন আগের চেয়ে জিপিএ ৫ পাওয়া তেমন কঠিন নয় কিন্তু আমাদের বেলায় কঠিন ছিল।  কারণ আমরা জানতামইনা সৃজনশীল কি? আমাদের থেকেই সৃজনশীল শুরু হয়েছে যদিও সকল বিষয়ে ভালো করলেও ইংরেজিতে একটু দুর্বল ছিলাম এর কারণ ছিল আমাদের স্কুলে ইংরেজি শেখানোর খুব একটা গুরুত্ব ছিল না। তবুও যে রেজাল্ট পেয়েছি তাতেই আলহামদুলিল্লাহ!পরীক্ষার পর বাসায় বসে বসে সময় কাটাতে লাগলাম। এই সময়টাতে বেশিভাগ স্কুলের স্মৃতি খুব মনে পরতো। যখন কিছু পাশে থাকে তখন তার মূল্য বোঝা যায় না। কিন্তু যখন হারিয়ে যায় তখন তার মূল্য বোঝা যায়। আর কোথায় পাবো প্রিয় সহপাঠীদের যাদের সাথে টিফিন এর সময় হলেই মাঠে গিয়ে খেলায় মেতে উঠতাম। কোথায় পাবো সেই মজার দিন গুলো হয়তো আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। জীবন যে জীবনের নিয়মে চলবে। 

প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত জীবনটা খুব সুন্দর ছিল। যখন আমরা সবাই মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতাম। তখন মনে হত এই স্কুলটা যেন একটা আনন্দের জায়গা। অনেক সময় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুরা সবাই মিলে খেলাধূলা করেছি। মন চায় আবার ফিরে যেতে কিন্তু পারিনা। সোনালী দিনগুলো শুধু স্মৃতির পাতায় আবদ্ধ। মনে পড়ে একই বই দিয়ে দু-তিনজন পড়া, সামনে ব্যাগ রেখে ঘুমিয়ে পড়া।একসাথে নামাজ পড়তে যাওয়া। তাদের সাথে খেলাধুলা করা সবচেয়ে প্রিয় ছিল। বিশেষ করে যাদের না দেখলে দিনটা খারাপ যেত । কোনো সহপাঠী স্কুলে না গেলে সেদিন তার কথা সবাই মিলে ভাবতাম। তারা এমন ছিল যে তাদের সাথে সারাদিন এর কথা শেয়ার না করলে যেন পেটের ভাত হজম হতোনা ।৪-৫ জন একই বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসে সারাদিনের মনের যতটা কথা শেয়ার করতাম।

এসব স্মৃতি ভাবতে ভাবতে হাই স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু হয়।আমি আর আমার প্রিয় কয়েকজন সহপাঠী একই স্কুলে ভর্তির আবেদন করি এজন্য অবশ্য ভর্তি পরীক্ষাও দিতে হয়েছে। আর ভর্তি পরীক্ষায় আমার রোল হয় ৪০। আর আমার বন্ধুর হয় ৩৮ । মনের ভিতর অনেক খুশি যে একই স্কুল থেকে আরেকটি স্কুলের নতুন পরিবেশে নতুন স্কুলে ভর্তি হবো। কেমন বন্ধু পাব? কেমন সহপাঠী পাব? কেমন স্যার ম্যাম পাব? আল্লাহ ভালো জানে! যা হবে ভালোই হবে। ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস এর প্রথম দিনে‌ আমি আমার বন্ধু আর সহপাঠীরা প্রথম বেঞ্চে বসি। প্রথম বেঞ্চে বসতে অনেক ভালো লাগে ‌আর ভালো পড়া বোঝা যায়। তাই প্রথমে বসি প্রথমে বসার কারণে প্রথম ক্লাসে পরিচিতি পর্বে গান গাওয়ার জন্য বলা হয়। বন্ধুর অনুরোধে প্রথম দিন ইসলামিক গান গেয়ে সবার কাছে পরিচিত হয়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া হতো যেমন তেমন আড্ডার গল্প হতো অনেক বেশি। আমরা‌ সহপাঠীরাও এক জায়গায় বসে আমরা গল্প করছি। নতুন স্কুল নতুন সহপাঠী নতুন স্যার ম্যাম সব মিলে নতুন একটা পরিবেশ। যেহেতু নতুন তাই ক্লাস শেষ না হতেই আমি আর আমার বন্ধু স্যার ম্যাম চলে যাওয়ার পর সবার আগে বের হতাম। আবার ছুটির পরেও সবার আগে বের হতাম।

আমি আমর বন্ধু আর কিছু সহপাঠী সাইকেল নিয়ে যাওয়া আশা করতাম। বেশিভাগ সময় টিফিন খেতে সাইকেল নিয়ে পালিয়ে এসেছি। পরের দিন অবশ্য জরিমানা বা শাস্তি পেতে হয়েছে। আমাদের জরিমানা টাকা দিয়ে স্কুলের জিনিস কেনা হতো, এই যেমন ঘড়ি ঝাড়ু ঝুড়ি ইত্যাদি। আবার অনেক সময় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হতো। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশোনা ঝামেলা তেমন ছিল না। পড়াশোনা একটু হলেও করেছি। এর জন্য সপ্তম শ্রেণীতে আমার রোল হয় ২০।আমাদের ক্লাসে যারা ভাল পারে তারা সবাই বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে। 

আর আমি আর আমার সহপাঠীরা সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। যার জন্য এই ফলাফল তবে আমরা মোটেও খারাপ ছাত্র ছিলাম না। যদিও নতুন করে কোন বন্ধু হয়নি সবার সাথে সহপাঠীর মতই মিলেমিশে থেকেছি। ঝগড়ার জন্য কখনো স্যার ম্যাডামের হাতে মার খাইনি। যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশোনা করেছি তখনো বুঝিনি জীবনের মানেটা আসলে কি? স্কুলে গিয়ে বেশিভাগ সময় সবার সাথে খেলাধুলায় মেতে থাকতাম। যদিও খেলাধুলার পাশাপাশি একটু পড়াশোনা করেছি ‌।আর নিয়মিত স্কুলে যেতাম  সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার চাপ ছিল না কিন্তু যখনই অষ্টম শ্রেণীতে পা রাখলাম পড়াশোনার চাপ বাড়তে থাকে।

অষ্টম শ্রেণীতে আবার আমার রোল হয় ২০। যখন অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম তখন আমার জীবনটা একদম বদলে গেল। বদলে যাওয়ার কারণ হচ্ছে অষ্টম শ্রেণীতে উঠতেই মা একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেয়। আর আমি স্মার্ট ফোন পেয়ে  তখন থেকেই রাত জেগে অনলাইনে থাকতাম। ফোন ছাড়া পড়তেই বসতাম না। আর আমার এক সহপাঠী ফেসবুক চালাতো। আর তার থেকে ফেসবুকের নিয়ম গুলো শিখে নেই।ধীরে ধীরে ফেসবুক আমার নেশায় পরিণত হয়। আমার অন্য কোনো নেশা নেই। সারাদিন যদি ভাত না খাই তবুও খুদা লাগতো না। 

ফেসবুক নেশার কারণে পড়ার টেবিলে পড়তে বসলে ও ফেসবুক, ঘুমানোর আগে ফেসবুক, সুযোগ পেলেই ফেসবুক চালাতাম। যার জন্য পড়াশোনা ঠিকমতো হতো না। এজন্য আম্মুর মুখে বকা খাইতাম তবুও ফোন ব্যবহার করা বন্ধ হতো না। ফোন নিয়ে সহপাঠীর সাথে আড্ডা দিতাম। ফেসবুকে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করে সময় কাটাতাম। কখনো শিক্ষামূলক, ও রোমান্টিক গল্প পড়তাম। আবার আমি গল্প ও লিখতাম‌। অনেক গল্প পড়ে হাঁসি পেত। আবার অনেক গল্প করে চোখে কান্না চলে আসতো আবেগে। নিজের জন্য কোনো‌ কষ্ট নেই কিন্তু অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না ।

অনলাইনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে কখন যে জেএসসি পরীক্ষা এসে গেছে টের পাইনি। কোনমতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দেই। আর রেজাল্ট মোটেও ভালো হয়নি! ভালো হবেই বা কিভাবে অনলাইন নেশা আর কিছু বাজে অভ্যাসের জন্য পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি।  অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকে বই না পড়লে এমনি তো হবে।সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো । স্কুলে না গিয়ে বাসায় বসে অনলাইনে থাকা আবার স্কুলে গেলেও টিফিন টাইমে পালিয়ে বাড়িতে আসা ।এসব ছিল আমার রেজাল্ট ভালো না হওয়ার পিছনের কারণ । অন্যদিকে আমার বন্ধুটা নিয়মিত স্কুলে যেত আর মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করতো। সেজন্য যেখানে দুজনে রেজাল্ট সব সময় একই হতো সেখানে আমার রেজাল্ট টা ভালো ছিল না। ও পেয়েছিল জিপিএ ৫ কিন্তু আমি ৪.৭৯। সেদিন রেজাল্ট পাওয়ার পর কান্না করেছিলাম ।আর ভেবেছিলাম আমার দোষ এর কারণে আমি রেজাল্ট খারাপ করেছি । আমি যদি আড্ডা দিয়ে না বেরিয়ে আরেকটু ভালো করে পড়তাম। তাহলে আমার রেজাল্ট ভাল হতো।

জীবনে আমরা সবাই ভুল করি। আর সেই ভুল যখন বুঝতে পারি ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। কিন্তু সে ভুলটা জীবনে একটা শিক্ষা দিয়ে যায় তখন আমরা বুঝতে শিখি। যে ভালো কিছু পেতে হলে সময় নষ্ট করা যাবে না। 

এজন্য ক্লাস নাইনে উঠে পড়াশোনা শুরু করি আর আর সব কিছু ফিরে পাই । আর সাথে পাই আমার কিছু স্বপ্নের বন্ধু , স্বপ্নের বন্ধু কেন বলছি তার যথেষ্ট কারন আছে কারন আমি ছোট থেকেই ভাবতাম আমার স্কুল লাইভে অনেক বন্ধু হবে, তাদের সাথে সময়টা হেঁসে খেলে পার করবো! আমরা সবাই মিলে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করবো! আমার স্বপ্ন পূরণ হয় আর ছেলে মেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো মিলেমিশে থাকলেও কিছু ছিল ক্লাসমেট, কারন বন্ধু তো সবাই হতে পারে না।ভালোই কাটতেছিল আমাদের সময়!

হঠাৎ করে সময় এসে যায় বিদায়ের ঘন্টা। স্কুল জীবন থেকে বিদায় নিতে হবে। অনেকেই স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের জন্য স্কুলে গিয়েছিল। শুধু মেয়েদের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যেতে বলেছে। যদিও দিনটি ছিল শুক্রবার মন ভালো নেই, তাই স্কুলে যায়নি। স্কুল থেকে বিদায় নিতে মন চাচ্ছে না। যেখানে শৈশবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেখান থেকে কি করে বিদায় নিব? বিদায় নামের শব্দটা শুনলেই যে বুকের ভিতরে কেমন করে ওঠে। বিদায় নামের শব্দ টা যদি না থাকতো তাহলে কতই না সুন্দর হতো জীবন। হয়তো শৈশবের মতো হাসি খুশি থাকতাম সব সময়। বিদায়ের দিন কিছুতেই মনটাই স্কুলে যেতে চায়নি। ১০ বছরের যে স্কুলে সময় কাটিয়েছি তা থেকে এক পলকেই কেড়ে নিবে বিদায় নামের শব্দ টা। এজন্য বিদায় নামের শব্দটাকে শত্রু মনে হয়েছে। 

মনের অজান্তেই স্কুলের আনন্দগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কেন যে বিদায় নামের শব্দ টা সবার জীবনে আসে। বিদায় আসলে কষ্টদায়ক তবু যে সবাইকে বিদায় নিতে হয়। সেদিন স্কুলে গিয়ে দেখি কেউ রান্না করছিল, কেউ গল্প করছিল, আর আমি নির্জনের মন খারাপ করে বসে ছিলাম। জীবন থেকে কিছু হারিয়ে ফেলার  ভয় হচ্ছে। যদিও বিদায়ের দিন প্রথমে মন খারাপ থাকলেও পরে বন্ধুদের জন্য মন ভালো হয়ে যায়। বন্ধুরা যে এভাবে পাশে থাকবে কখনো ভাবতেই পারেনি। আর কোথায় পাবো সেই বন্ধুত্ব, কোথায় পাব সে আনন্দ কোথায় পাবো সেই মজার দিন গুলো একসাথে ক্লাসে বসে আড্ডা দেওয়া, একসাথে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করা, আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় মাথায় এসব ভাবনা। আর সামনে এসএসসি পরীক্ষা ছিল তাই সকল চিন্তা ভাবনা থেকে কাটিয়ে উঠে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই।

প্রথমদিন বাংলা প্রথম পরীক্ষা। বুঝতেছিনা কেমন হবে পরীক্ষা। আল্লাহর রহমতে প্রস্তুতি নিয়েছি ভালোই। তবু যেন মনের ভিতর একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে পরীক্ষার জন্য। আগের রাতে দশটা পর্যন্ত পড়েছি। সকালেও পড়েছি, কিন্তু সময় হাতে খুবই কম, বাসা থেকে সকাল ৮ টায় বের হই, কারণ পরীক্ষা শুরু হবে সকাল দশটায়। কিন্তু আধা ঘণ্টা আগেই পরীক্ষার রুমে যেতে হবে। মনে অনুভূতি আর হাতে প্রবেশপত্র কলম পেন্সিল নিয়ে গাড়ি করে যাই।। সেদিন ছিল একটু করে কুয়াশা, চারদিকে কুয়াশায় ঘেরা শুধু একটু একটু করে উঁকি দেয়। প্রায় এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে দেখি অনেকেই উপস্থিত। আধাঘণ্টা ধরে ঘোরাঘুরি বন্ধুদের সঙ্গে গল্প আর বসার সিট খুলে খুঁজে বের করা হয়। আমার সামনে আমার বন্ধু আর পাশে একটা ছেলে পড়ে। 

প্রথমদিন সময়ের অভাবে সাতটা সৃজনশীল এর ভিতরে ৬ টার উত্তর করি। বলতে গেলে প্রথম পরীক্ষাটা ভালো হয়নি। কিন্তু পরের দিন বাংলা দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষা ছিল। এজন্য প্রথম পরীক্ষা দিয়ে এসেই পড়তে বসি, রাত ১১ টা পর্যন্ত পড়ি। এরপর ঘুমিয়ে পড়ি। আর সকালে উঠে গোসল করি। খাওয়া-দাওয়া করে সাড়ে আটটায় কেন্দ্রের দিকে রওনা দেই। সেদিন পরীক্ষাটা ভালো করে মনোযোগ দিয়ে দেই। পরীক্ষা দেওয়ার পর বুঝতে পারি প্রথম পরীক্ষা যেমন দিয়েছি তার চেয়ে পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। ইনশাআল্লাহ দুইটা বিষয় মিলে প্লাস আসবে। মন ভালো থাকলে পরীক্ষা তো ভালো হবেই। বাংলা পরীক্ষার পর ইংরেজি পরীক্ষা খুব টেনশন হচ্ছিল। কারণ আমি ইংরেজিতে একটু দুর্বল। বাংলা ভাষায় কথা বলি তো ইংরেজি খুব একটা মাথায় ঢোকে না। অনেক চেষ্টা করেছি। রাতে অনেক পড়েছি যদিও পরিক্ষার আগে পড়া উচিত না তবুও কি আর করার ভালো করার জন্যই পড়েছি,  সকালে উঠে মাথায় অনেক টেনশন নিয়ে কেন্দ্রে যাই। বন্ধুদের দেখে সব টেনশন কোথায় যেন হারিয়ে যায়। খুশিমনে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ভিতরে যায়। ভিতরে গিয়ে দেখি সবাই দলে দলে গল্প করতেছিল। 

আমি আর আমার এক বন্ধু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। ঘন্টা দেওয়ার পর রুমে গিয়ে বসে পড়ি। খাতা আর প্রশ্ন পাওয়ার পর মন দিয়ে লেখা শুরু করি। বন্ধুদের জন্য পরীক্ষাটা ভালো হয়েছে। এরপরের দিন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার দিনে কেন্দ্রে যেতে একটু দেরী হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি সবাই ভিতরে ঢুকেছে। আমিও পরীক্ষার রুমে যাই। এবং মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দেই। মোটামুটি পরীক্ষাটি ভালো হয়েছে এরপর গণিত পরীক্ষা। মাঝখানে যেহেতু একদিন বন্ধ ছিল সেই সময়ে গণিতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাথ বারবার চর্চা করি। জীবনের বেশিরভাগ সময় গণিত নিয়ে সময় কাটিয়েছি। প্রাইভেটে স্কুলের ক্লাসে কোচিংয়ে গণিত বিষয়ে পড়া হতো বেশি বেশি। তবু যেন গণিত বিষয়ে দুর্বলতা থেকেই যায়। কিন্তু পরীক্ষা আর এক বছর আগে থেকে গণিত যেভাবে পড়েছি তাতে প্রশ্ন যেভাবে আসুক না কেন ইনশাল্লাহ কমন পড়বেই। আর কেন্দ্রে গিয়ে দেখি তাই হয়েছে কমন ছিল ঠিকই, কিন্তু সময়ের অভাবে উত্তর করতে পারিনি। এটা শুধু আমার নাম বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী গণিত পরীক্ষা এরকম হয়েছে। 

গণিত পরীক্ষা যেহেতু একটু খারাপ হইছে তাই রেজাল্ট কেমন হবে আল্লাহ ভালো জানে। তবে বাকি পরীক্ষাগুলো যদি ভালো হয় তবে রেজাল্ট ভালোই হবে। পরের দিন পরীক্ষা আছে কিন্তু শুধু বহুনির্বাচনি পরীক্ষা, লিখিত কিছু নেই। তাই কেন্দ্রে আগেই গিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। সহপাঠী বন্ধুরা কে কোন জায়গায় বসেছে সেটা দেখার জন্য তাদের রুমে রুমে গিয়েছি। যেহেতু আইসিটি পরীক্ষার সময় বেশি লাগবে না তাই সবাই পরীক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি করে চলে যায়।

পরের দিন পহেলা ফাল্গুন ফুল ফুটুক আর না ফুটুক বসন্ত এসেছে। আর বসন্ত মানে গাছে গাছে নানা রঙের ফুল। গাছের ডালে কোকিল এর গান। ভালোবাসার ঋতু তো বসন্তকাল। বাতাসে সেদিন বইছে ভালোবাসার রং। আর ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে গিয়ে আমার বন্ধুদের ফাল্গুনের শুভেচ্ছা জানায়। আর সবাই খুশিতে ছিল কারণ সেদিন ছিল কৃষি পরীক্ষা এ পরীক্ষা ভালো হলে রেজাল্ট ভালো হবে তাই যে করেই হোক কৃষি পরীক্ষা ভালো করে দিতে হবে। 

কৃষি পরীক্ষা দিতে গিয়ে মনে পড়ে যায়, সেই কৃষি ক্লাস গুলোর কথা যেখানে খুব কাছ থেকে বন্ধুদের সাথে কথা বলে ক্লাস করা হতো। মানবিক বিভাগের বিষয়ের জন্য আমরা যখন কৃষি ক্লাস করার জন্য বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা মেয়েদের রুমে যেতাম তখন আমি আমার বন্ধুর সাথে একই সিটে বসতাম। ক্লাস হতো যেমন তেমন গল্প হতো প্রচুর। ক্লাস শেষ হয়ে যেত, কিন্তু গল্প শেষ হত না। গল্প করতে করতে ম্যাডাম যখন দেখতো তখন পড়া ধরত। আর পড়া না পারলে বসতে দিত না, দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি বেশিভাগ সময় পড়া পারতাম। আর ম্যাডাম আমাকে পড়া ধরতো। যারা ভালো পারে তাদেরকে আদর করে আর পড়া ধরে। স্যার ম্যামের কাছে অনেক আদর পেয়েছি।তাদের আদর গুলোর কথা খুব মনে পড়ছে।সত্যি স্যার ম্যামরা আমাদের জীবনের একটা অংশ। 

মনে পড়ছে ক্লাসের গল্প করার মুহূর্তের কথা। আমরা বন্ধুরা যখন তখন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করেছি। আমরা সাইন্সের দুই বন্ধু বলি আর্সের বিষয় খুব সহজ। আমাদের সাইন্সের বিষয় খুব কঠিন।তারা বলতো পদার্থ অনেক সহজ, খুব সহজে নাকি পরীক্ষা দিতে পারবে। পরের দিনই ছিল ইসলাম। পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার সময় ইসলামের নানা ঘটনা একে অপরকে শেয়ার করি।  পৌঁছে বন্ধুদের সাথে দেখা। ওদের সাথে একটু মজা করি। আর আমার বন্ধুদের সাথে মজা করতে অনেক ভালো লাগে। তাছাড়াও আমার বন্ধুদের ভালবাসার প্রতি আগ্রহ বেশি! এরপর পরীক্ষা দেই আমার পরীক্ষাটা ভালো হয়েছে ধর্ম পরীক্ষা তো তাই খুব একটা কঠিন হয়নি। তিন-চারদিন পর রসায়ন পরীক্ষা। 

সময় যেন তার নিজ গতিতে ছুটে চলছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গোসল করে নেই। গোসলের পর খুব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে কিছু খাবার খেয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে। কিসের যেন একটা টান হয়তো বন্ধুত্বের টানে। বন্ধু ও সহপাঠীদের অনেকদিন হল দেখিনি। কেন্দ্রে গিয়ে তাদের দেখলাম তাদের দেখে মন না ভরলে ও মনটা তো একটু ভালো হয়েছে। আর মনটা ভালো থাকায় পরীক্ষাটা ভালো হয়েছে।

পরের দিন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যেখানে স্কুলে থাকার কথা সেখানে আজ বাসায় একদিন ছুটির দিন আবার অন্যদিকে স্কুল থেকে বিদায় নিয়েছি, তাই একুশে ফেব্রুয়ারি স্কুলের দিনগুলো খুব মিস করছি। সেদিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু খেয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিয়ে স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীরা একজোট হয়ে লাইন ধরে শোক সভা ও র্যালি করেছি। কতই না মজার ছিল দিনটি, খালি পায়ে র্যালি করা সত্যি অনেক মজার ছিল। সাথে ছিল মুখে কত রকমের গান। আবার শহীদ মিনারে ফুল দিতাম কিন্তু সময়ের পরিবর্তে পরিক্ষার জন্য কিছুই করা হয়নি, স্কুলজীবন হারিয়ে কিভাবে যে থাকবো সেটা যে ভাবনার বিষয় জীববিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে গিয়ে দেখি কেমন ফাঁকা ফাঁকা। আমরা শুধু সাইন্সের ছাত্র ছাত্রীরা আর আমি কিছু বন্ধুদের খুব মিস করছি, বৃষ্টির পরিবেশ ফুটে উঠেছে আমি বাইরে বৃষ্টি পড়া দেখছি। 

আমার ভেতরটা যেন বৃষ্টির মত কান্না করছে। শুধু জল পড়ছে না এ যেন জল বিহীন কান্না। স্কুল লাইফের বন্ধুদের হারানোর ব্যথাটা কতটা কঠিন তার কিছুটা অনুভূতি টের পাই। আর মাত্র হাতে গোনা কয়দিন তারপর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে স্কুল জীবন। আর চাইলেই ফিরে পাবো না বন্ধুদের সাথে কাটানো সেই মুহূর্তগুলো। সেদিন আমাদের সাইন্স এর ব্যবহারিক বাদে সব বিষয়ে পরীক্ষার শেষদিন ছিল। এই পরীক্ষা হয়ে গেলে আর পরীক্ষার কোন চাপ থাকবে না। এসব ভাবতে ভাবতে কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। ভালো করে পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি। আশা করি যে পরীক্ষাগুলো দিয়েছি আল্লাহর রহমতে পরীক্ষার রেজাল্ট গুলো ভালো হবে ইনশাআল্লাহ!

অনেকদিন পর রাতে একটু হলেও ঘুম হয়েছে। পরীক্ষার ভেতর মাথায় যে চাপ থাকে তাতে ঘুম তো দূরের কথা চোখ বন্ধ করলেও দেখি পরীক্ষা দেই। পরীক্ষা আমার কাছে ভয়ের কোন কারন নয়, কিন্তু পরীক্ষা অনেকটা ঝামেলা বটে। পরীক্ষার আগে জীবনেও বই পড়ে শেষ করতে পারিনি। বই হাতে নেওয়ার পর প্রথম প্রথম পড়তে ভালো লাগে কিছুদিন গেলে বই পড়তে অসহ্য লাগে।আসল কথা তখন আর পড়তে মন চায় না। পড়তে বসা তো দূরের কথা বই নিয়ে বসলে শুধু মাথা ঘোরে ঘুম পায়। কাল থেকে পড়বো বলে বই রেখে দেই। 

পড়াশোনার বিষয় নিয়ে কেউ কিছু বললে তা শুনে মনে মনে ভেবে নিতাম কাল থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করব। কিন্তু জীবনে সেইভাবে কালটাই আসেনি। যদিও পড়তে বসতাম তবে ফোন নিয়ে। পড়ার টেবিলে ফোন না থাকলে ফোন ছাড়া পড়তে বসতাম না। ফোন থাকলে তাও একটু একটু পড়া মুখস্ত হত। পরীক্ষার মাঝেও ফোন আমার কাছে ছিল, কিন্তু ফোন ব্যবহার একটু কম করি পরীক্ষার প্রতি রাতে একটু হলেও পড়েছি। দুইটা বছর পড়বো পড়বো করে পরিনি আবার পরীক্ষার রাতেও যদি না পড়ি, তাহলে ভালো রেজাল্ট হবে না। আর সারা জীবন শুধু  আফসোসই করতে হবে। পড়াশোনা না করে কি ভুলটাই না করেছি। রসায়ন পদার্থ ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনে কেন্দ্রে গিয়ে মনের ভিতর শুধু একটা কথাই হচ্ছিল, ব্যবহারিক পরীক্ষা টা হবে কিভাবে? আর দিব বা কি করে? আজকে আমাদের সাইন্সের বিষয় থাকলেও অনেক বন্ধুর কৃষি বিষয়ে ব্যবহারিক ছিল। তাই বলতে গেলে আজকেই আমাদের শেষ দেখা। ওদের আমি খুজতেছিলাম। হঠাৎ দেখি সে উপরে একটা রুমের সামনে একটা বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে।  তাকে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আজকের পর হয়তো কাউকে আর আমি সরাসরি দেখতে পাবো না। 

তাকে শুধু একটা কথাই বলি ভালো থেকো।আমি আর আমার প্রিয় বন্ধু দুজন ভিন্ন স্কুলের সাথে পড়েছি। পরীক্ষাটা ছিল প্রথমে লিখিত, তারপর মৌখিক। পরীক্ষাটা ভালোই হয়। আমরা আগে থেকে ঠিক করি যে আমরা মহাস্থানে বেড়াতে যাব। আর আমরা তাই করি আমি ভাবছিলাম আরো সহপাঠী   বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। সবাই গিয়েছিলো নাকি যায়নি সঠিক জানিনা। চারপাশে অনেক খুজেছি তাদের। কিন্তু তাদের খুজে পাইনি। বারবার মনে হয়েছে হয়তো তাদের আর কখনো খুঁজে পাবো না। আমার সাথে আর বন্ধুরা ছিল তো ঘোরাঘুরি করে বাসায় চলে আসি। পরের দিন জীববিজ্ঞান শেষ পরীক্ষা ছিল শুধু আমাদের সাইন্সের তাই আমি আর আমার বন্ধু কেন্দ্রে যাই। 

এরপর শেষদিন কৃষি ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। সেদিন মোটরসাইকেলে করে যাই স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষা তারপর স্কুল লাইফে আর কোন পরীক্ষা দিতে পারব না। আমার পরীক্ষা শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে ১২টা আর আমার বন্ধুর পরীক্ষা শেষ হবে ২টায় এজন্য আমি দেরি করি। আমার পরীক্ষায় প্রথমে ছিল তাই আমাকে আগে যেতে হয়। পরীক্ষায় ভালো নাম্বার এর জন্য  দেশের গান গাইতে হয়েছে। আমার পরীক্ষা শেষে আমার বন্ধু যে রুমে পরীক্ষা দিবে সেই রুমে গিয়ে বসে থাকি।  পরীক্ষার পর মনটা যেন কিছুতেই বাসায় আসতে চাইছিল না। স্কুল জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাবে ভাবতে চোখে কান্না চলে এসেছিল। কেন্দ্রে থেকে কিছুতেই বের হতে চাইছিলাম না বন্ধু আমাকে ডেকে ডেকে বের করে নিয়ে আসে আমি বারবার স্কুলের দিকে ফিরে তাকিয়েছি।

বাসায় এসে ভাবছিলাম, স্কুল জীবনটা কেন শেষ হয়ে যায়।তিন অক্ষর নামের বিদায় শব্দটা যে কতটা কষ্টদায়ক বিদায় ক্ষণে বুঝতে পেরেছি। জীবন থেকে যে কি হারিয়ে গেল তা কিছু তা হলেও টের পেয়েছি। পরের দিন সকাল থেকে শুধু স্কুলের কাটানো দিন গুলোর কথা মনে পড়েছে। ইচ্ছে থাকা সত্বেও স্কুলে যেতে পারিনি। বিদায়ের কারণে শৈশবের স্কুলের স্মৃতি গুলো কখনো তো ভুলে থাকা যাবে না। সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। আমি সেদিনের মতো মজা আর হয়তো পাবো কিনা জানিনা। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা, ক্লাসের পড়ার ফাঁকে কথা বলা, এজন্য শাস্তি পাওয়া, সব যেন মনে পড়ে যায়। সবচেয়ে মজার সময় ছিল টিফিন টাইম। 

টিফিনের জন্য মনটা আমার আনচান করত। আর টিফিন দিলে খুশি হয় ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় চিল্লাচিল্লি করেছি। কোনদিন স্কুলে টিফিন করেছি। আবার কোনদিন বাসায় এসে বেশিরভাগ সময় টিফিন টাইমে পালিয়ে বাসায় এসেছি। যদিও ছুটি নেওয়ার জন্য পত্র লিখতে হতো কিন্তু পত্র আর কে লেখতো। কোন কোন দিন স্যার ম্যাম এর কারণে পালাতে না পারলে মনটা একটু খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু ক্লাসে কিছু বন্ধুর পাশে বসে ক্লাস করলে মনটা ভালো হয়ে যেত। আর যদি কোন ক্লাস ভালো না লাগতো।পানি খাওয়ার নাম করে পুরো স্কুল ঘুরে বেড়াতাম। কখনো আবার সবাই মিলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারতাম। বেশিভাগ শেষ ক্লাসে আড্ডা বেশি হত। আড্ডা দিতে দিতে যখন ছুটির ঘন্টা দিত সবার মুখে হাসি ফুটে উঠত। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ছুটির ঘন্টা যে কত প্রিয় তা ছুটির সময়টা তেই বোঝা যায়। ছুটির সময় তাড়াহুড়া করে আগে বের হওয়ার জন্য মাঠের দিকে দৌড়ে গিয়ে গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় সামনে ধাক্কা দিয়ে বলতাম কে ধাক্কা দেয় রে বালডা! 

ছুটি শেষে বাসায় এসেই স্কুলের ড্রেস আর কাধের সেই ছোট ব্যাগটা রেখে দিতাম। সপ্তাহের মাঝে শুক্রবারের দিন টা তে ধুয়ে দিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন আর ধুয়ে দিতে হচ্ছে না। স্কুল ড্রেসটা পড়ে আছে আর পরিনা। তাই ময়লা জমে না। অন্যদিকে ব্যাগটা পরে আছে যে ব্যাগ প্রতিটি দিন সিট ধরার অস্ত্র হিসেবে কাজ করতো। সিটের জায়গার জন্য কত মারামারি করেছি । মারা মারির জন্য স্যারের হাতে মার না খেলেও হোমওয়ার্কের জন্য শাস্তি পেয়েছি। কখনো ক্লাসে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা আবার কখনো বারান্দায় নিল ডাউন করে রাখার স্মৃতি বেশি মনে পড়ে। বারান্দায় যখন কান ধরে দাঁড়িয়ে রাখতো বন্ধুরা মিলে তখন আড্ডা মারিতাম। এখন হয়তো সে আড্ডা হচ্ছে কিন্তু আমি আর আমার প্রিয় সহপাঠী ও বন্ধুরা আর নেই।

সহপাঠী ও বন্ধুদের সাথে মজার স্মৃতি আর হয়তো ফিরে পাবোনা, পাবোনা বন্ধুদের মত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। বন্ধুদের সাথে ক্লাসে বসে গান গাওয়ার সেই আড্ডা গুলো। শুধু যে ক্লাসে আড্ডা তা না পরীক্ষা দেওয়ার সময় একসাথে স্যারের সাথে চিটিং করে আড্ডা দিয়েছি। নিজে দোষ করলেও অন্যের কথা বলে বেঁচে যাওয়ার শাস্তির কথা মনে পড়লে হাঁসি পায়। এখন সেই স্কুলের সামনে দিয়ে গেলে বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করে। মনে হয় যেন এখনই আবার সেই আগের মতই স্কুল ড্রেসটা পড়ে বন্ধুদের সাথে হাঁসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে। কিন্তু তাতো আর সম্ভব নয়।পাবো না ফিরে যেতে আর সেই দিন, সেই দিন গুলো মনে আঁকি স্মৃতির রং তুলি দিয়ে।এখন শুধু স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে জীবন নামের গল্পের পাতায়।

শিক্ষার্থী; ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার, গাবতলী গভমেন্ট কলেজ, বগুড়া

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মায়াবী নদী - স্বপ্না ফাতেমা

স্মৃতির পাতা - সানজিদা হোসাইন