স্মৃতির পাতা - সানজিদা হোসাইন

সানজিদা হোসাইন

গ্রীষ্মকাল-এর মানেই হলো স্কুলে গরমের ছুটি। আর এই ছুটি মানেই হলো নানাবাড়ি বেরাতে যাওয়ার তাড়া। কারণ এটা হলো  আম পাকার সময়।

আমার নানা বাড়ি খুব বেশি দুরে না,আমার গ্রাম থেকে চার-পাঁচ গ্রাম পেছনে।আর গাড়ির সুবিধা হওয়ার খুব বেশি সময় লাগে না। তাই স্কুল বন্ধ হলেই সোজা নানাবাড়ি যেতাম।মামা-মামী, নানা-নানু,ভাইয়া আর ছোট ভাই নিয়ে আমার নানা বাড়ি।ছোটো খাটো নয়,মোটামুটি বিশাল এক বাড়ি আমার নানাভাইয়ের। মা বলে আগে আরও নাকি বড় ছিলো,বাড়ি ভাগ করায় এখন মাঝে এক দেয়াল দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের সম্পর্কে কোনো দেয়াল ওঠে নি। বাড়ির তিন দিকে শুধু আম গাছ। আম পাড়লে কেউ কিছু বলে না। তাছাড়া অন্যদের গাছের আম পেড়ে আনতাম, তারাও কিছু বলতো না।আর আমার এলাকায় যদি এমন করি তো,বাড়ি এসে মায়ের কাছে নালিশ করে যাবে।এজন্যই তো নানা বাড়ি খুব পছন্দের। কোনো বাধা নেই,ওই কটা দিন নিজের ইচ্ছে মতো কাটতো। যখন আমরা সব ভাই-বোন একসাথে হতাম সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।সবাই আমায় অনেক আদর করতো কারণ,আমার মা বাড়ির ছোট মেয়ে,আর আমিও সবার ছোট।পরে অবশ্য আরও মেহমান এসেছে সে অন্য কথা।বড় মামার দুই ছেলে আর ছোট মামার এক ছেলে এক মেয়ে ওরা এখন ছোট। আমরা ভাই বোন মিলে বাড়ির পেছনের আম গাছ গুলো ভাগ করতাম।ওরা আমায় টক আম গাছটাই দিত,আমিতো ছোট ছিলাম তাই বুঝতাম না।নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে শুধু ঘুরে বেড়াতাম।এগাছে ওগাছে ঢিল ছুঁড়তাম, পুকুরে মাছও ধরতাম আরও কত কি। মাঝরাতে যখন হঠাৎ ঝড় ওঠত,তখন নানাভাই আজান দিত। সবাই কে ঘরে বসতে বলত। কিন্তু আম কুড়ানোর লোভ কি সামলানো যায়। বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে আম্মু, মামী,খালা আর নানু আম কুড়ানোর জন্য লুকিয়ে বেরিয়ে যায়।ঝড়ের শেষে ব্যাগ,গামলা আচল ভরো আম নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই শুরু নানার বকাবকি। কিন্তু সব বকা কেউ কানেই নিত না,সব মাথার উপর দিয়ে পার করে দিত।

খুব ভোরে নানু যখন ময়লা ফেলার জন্য যেত,তখন পুকুরে পাড়ে আসা বড় বড় পাঙ্গাশ, রুই,কাতলা ধরে আনত। তাল পাকার সময় নানা ব্যাগ ভরে আমাদের তাল দিয়ে যেত। গাছের নিচে তাল পরে আটি বেরিয়ে ঘেলে নানু বস্তা ভরে তা আনত।আর তার শাশ বের করে দিত আমাদের।

বাড়ির সামনে বিশাল এক ফাকা যায়গা,ওখানে আমরা সবাই খেলার পর্ব সারতাম। দুপুরে যখন মা জোর করে ঘুমোতে নিয়ে আসত তখন,আমরা চুপিচুপি বাইরে চলে যেতাম। তার পর বিকেলে বাড়ির সবাই মিলে চেয়ার,মোড়া,মাদুর পেতে বসে আড্ডা দেওয়া হতো।সেই দিন গুলো কতোই না সুন্দর ছিল।সেই দিন গুলো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।সেই মুহূর্ত গুলো,একসাথে আম পাড়া,বকুনি খাওয়া, মাছ ধরা,সাতার কাটা,কে কত দুরে পুকুরে লাফ দিতে পারে সেই প্রতিযোগীতা আর নেই।বড় হওয়ার সাথে সাথে সব স্মৃতির পাতায় বন্দী হয়ে গেছে। সবাই বদলে গেছে,এখোন তো ভাই সামনে আসলেও কেউ কারো সাথে কথা বলি না।বয়সের সাথে সাথে দুরত্বও বেরে গেছে। আর এক সময় ছিল অফুরোন কথা।গ্রামীন মধ্য বিত্ত পরিবারের ছেলেেয়েদের জীবন খুব জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী হয় না,তবুও তার মধ্যেই নিজেদের জন্য রঙিন মুহূর্ত বের করে নিতাম।

সেই ছোটবেলা এখন আর নেই,সবাই বদলে গেছে। ভাই বড় হয়ে গেছে, বোনদের বিয়ে হয়েছে। আমাদের মাঝে আরও নতুন মানুষের আগমন হয়েছে। বাড়ি,বাড়ির মানুষরাও বদলে গেছে। এখন আর সেই ভাবে নানু বাড়ি যাওয়া হয় না।  কারন,এখন গরমের ছুটি মানেই বই নিয়ে জলদি সিলেবাস সম্পূর্ণ করার তাড়াহুড়ো। আগে শুক্রবার মানে ছিল ছুটির দিন আর এখন,সারা সপ্তাহের ঝামেলা গোছানোর দিন।  আগের রঙিন জীবন যেন একেবারে সাদামাটা হয়ে গেছে।ধীরে ধীরে হয়ত আরও বদলে যাবে এ জীবন। শুধু বদলাবে না সেই পুরোনো স্মৃতিগুলো।মনে হয় আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই পুরোনো দিনে,তবে যে ইচ্ছে টা পুরন করতে পারিনি তা পুরন করে আসতাম,এই একই ইচ্ছে সব মানুষের ই হয়।আরোও ২০ বছর পরেও আমি সেই দুরন্ত ১০ বছরের ই থাকব সেই ছোটবেলায় পুরোনো তোলা ছবিতে।আমি সবার সাথে না থাকলেও সেই স্মৃতি গুলো থেকে যাবে মৃত্যু পর্যন্ত স্মৃতির পাতায়। আজও যেন কিছু অনুভূতি অসম্পূর্ণ।

শিক্ষার্থী; গাবতলী সরকারি কলেজ, বগুড়া

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মায়াবী নদী - স্বপ্না ফাতেমা

শৈশবের স্কুল জীবন - আবু তাহের ইসলাম